সন্তান প্রতিপালন–১৪

বাচ্চাদেরকে খেয়াল রাখার ব্যাপারে বয়সের কোন সময় সীমা রেখা নেই। একেক বয়সে একেক ভাবে খেয়াল রাখতে হবে। একেবারে ছোট বেলায় খেয়াল রাখতে হবে যে, যাদের মধ্যে সে বড় হচ্ছে তাদের সাথে তার সম্পর্ক গুলো কি রকম? সাধারণত মাহরামের বাইরে বাচ্চাকে কিন্তু কারো হাতেই দিবো না। কারণ অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই বাচ্চারা নানা ভাবে এবিউস হতে পারে। এমন কি মাহরাম কারো সাথে সময় কাটানোর সময়ও খেয়াল রাখবো। তবে শুধু শুধু সন্দেহ করবো না। যদি কখনো পরিবারের আপনজনদের খারাপ অভ্যাস সম্পর্কে অবগত হোন যেমন পর্নআসক্ত, নেশাকরা, কোন হারাম সম্পর্কে লিপ্ত ইত্যাদি এদের থেকে নিজে সতর্ক থাকতে হবে এবং ছোটদেরকেও সাবধান করতে হবে৷ এরা সম্পর্কে মাহরাম হলেও তাদের সাথে পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে। পরিবারের কারো যদি sexual OCD ( যৌন চিন্তা বার বার আসে এবং তার জন্য তাকে চিকিৎসা নিতে হয়) থাকে তাহলে তার সাথেও পর্দা রক্ষা করতে হবে। এ বিষয় গুলো আমাদের খুব বেশী খেয়াল করা দরকার। কারণ এর ক্ষতিকর প্রভাব কারো অনেক বেশী থাকে আবার কারো ক্ষেত্রে সারা জীবনও থাকতে পারে । বাচ্চাকে বোঝাতে হবে যে, প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত কোথায় কি হয় সব কথা বলতে হবে কারণ অনেক সময় বাবাকে সব কথা বলা যায় না। কেউ যদি নিষেধ করে দেয় বাবা মাকে না জানাতে তবুও বলতে হবে। 

অনেক সময় আমরা বাচ্চাদেরকে একা ঘরে রেখে কাজে চলে যাই অথবা জরুরী কাজে বাইরে যাই। কেউ কিছুক্ষণের জন্য আবার কেউ সারাদিনের জন্য। এ সময় অনেক ধরণের অঘটন ঘটে এবং ঘটতে পারে। নিজে অথবা কয়েকজন বাচ্চারা যখন একা থাকে তখন নিজেরাই অনেক দুর্ঘটনা ঘটায় অথবা এবিউসের শিকার হয়। এমনকি টিনেজারদেরও একা রেখে যাওয়া উচিৎ না। কারণ শয়তানের কুমন্ত্রণায় এরা অনেক ধরণের পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। আবার ছোট বাচ্চাদেরও একজন টিনেজারের তত্বাবধানে রেখে যাওয়া ঠিক না। আমাদের সময় এতো ফিতনা ছিলো না। এখন এতো ফিতনা যে আমাদেরকে অনেক সতর্ক হতে হবে। 

আমাদের অনেক ধরণের মানুষের সাথে আসা যাওয়া থাকবে। সামাজিক বন্ধনের জন্য এর যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি এটাও মনে রাখতে হবে কাদের সাথে আমরা মিশছি। সেটা খুবই খেয়াল করা দরকার। দ্বীন পালনে একরকম সবাই হবে না, হয়ওনা। এটা আমার খেয়াল রাখবো। বাচ্চাটা যেন বিভিন্ন ধরণের ডিভাইস ব্যবহার করতে না পারে সেটা খুবই ছোট বেলা থেকে খেয়াল রাখবো। বাচ্চারা খুব সহজেই এগুলোতে আকৃষ্ট হয়। যে কেউ বাচ্চাদেরকে এগুলো দেখায় এবং এগুলো দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এটার ক্ষতিকারক দিকগুলো জেনেও আমরা পাত্তা দেইনা। এমনকি বাচ্চাকে যদি নাও দেয়া হয় স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কে যদি কেউ দেখে যে ক্লাসের মধ্যে সে ব্রাউজ করছে অথবা বাসায় যদি দেখে বাবা মা এগুলো ব্রাউজ করছে তবে সে ভাববে যে, হয়তো আপাততঃ এটা তার জন্য নিষেধ আছে কিন্তু একটু বড় হলেই সে এটা ব্যবহার করতে পারবে। সে ভাববে এটা ব্যবহার করা এমন কোন দোষের বিষয় না। এভাবেই সমস্ত খারাপ গুলো চলে আসে। বাবা মাকে যেটা করতে অভ্যস্ত দেখবে ভবিষ্যতে সেও এটা করবে এমন ধারণা তার মাথায় থাকবে। পড়াশোনার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করতে দিবো। পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিকগুলো সব সময় বুঝিয়ে বলতে থাকবো। 

বাচ্চারা আশেপাশে এবং স্কুলের নানা ধরণের বাচ্চাদের সাথে মিশবে। এ মেশাটা সামাজিক বন্ধনের জন্য অনেক জরুরী। তবে আমরা খেয়াল রাখবো তাদের পরিবার গুলো কোন ধরণের। পরিবার গুলো যদি ইসলামিক হয় তবে সুবিধাজনক এবং এদের সাথে যেন বাচ্চারা বেশী সময় কাটায়। অন্যদের সাথে তারা বেশী সময় কেন কাটাবেনা সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবো। যেমন তারা অন্যভাবে চলছে সেটা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। এটা থেকে কি কি ক্ষতি হতে পারে সেটাও তারা যে ভাবে বোঝে সে ভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করবো। বাচ্চা যখন একটু বড় হয়ে যাবে তাদেরকে ঐ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না যেভাবে ছোট বেলায় করেছি। তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য এটার প্রয়োজন আছে । কিন্তু এটাও ঠিক কাদের সাথে মেলামেশা করছে এটা জানা অত্যন্ত জরুরী। তাদের পরিবারের সাথে সব সময় একটা যোগাযোগ এবং যাতায়াত থাকতে হবে। আমাদের বাবা মায়েরা কিন্তু আমরা যাদের সাথে মিশেছি তাদেরকে এবং তাদের পরিবার গুলোকে জানতেন এবং চিনতেন। এভাবে দ্বীনের দাওয়াহ্ দেয়া হবে এবং বাচ্চার প্রতি খেয়ালও রাখা হবে। তারপর তারা কি করছে সেটা আমরা অন্যভাবে জেনে নিবো।

 বিভিন্ন বয়সে বাচ্চাদের আচার-আচরণ বিভিন্ন ধরণের হয় সেটা আমাদেরকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহিত করতে পারি যে গুলো করার মধ্য দিয়ে সে ব্যস্ত থাকবে। তাদের হাতে বই তুলে দেয়ার সাথে সাথে আরো কিছু করতে পারি যেমন কিছু বানানো বা কোন কিছু খেলা। অন্য বাচ্চারা যখন বাসায় আসবে তখন তাদেরকেও এ ধরণের জিনিস গুলো দিতে পারি। ওরা যখন অন্য কারো বাসায় যাবে তখনও সেটা দিতে পারি। কোরআন এবং হাদীস থেকে কিছু করতে দিতে পারি। এ ভাবে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে।

অনেককে দেখা যায় নিজের বাসায় কেউ আসলে নিজের বাচ্চা এবং অন্য বাচ্চাদের ডিভাইস দেখতে অথবা সিনেমা দেখতে দিতে। তারপর নিজেরাও গল্পে মশগুল থাকেন এবং এর ফাঁকে ফাঁকে নিজেরাও মোবাইল ব্রাউজ করেন। আবার কারো বাসায় গেলে একই কাজ করেন। এমন কি বাইরে বেড়াতে, কোন ইসলামি অনুষ্ঠানে, মসজিদে, অথবা অন্য কোন জায়গায় গেলেও একই কাজ করেন। এ ধরণের বাবা মায়েরা অথবা বাচ্চারা এতোই আসক্ত যে বাচ্চা গুলো স্বাভাবিক খেলাধুলা অথবা কোন কার্যক্রম নিয়ে বেশীক্ষণ ব্যস্ত থাকতে পারেন না। একটু পর পর তাদের ডিভাইসের কাছে যেতে হয়। আমরা বাচ্চাদের সামাজিক বন্ধনের জন্য কোন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। অথচ যদি এগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকি তবে আমাদের মধ্যে বন্ধন গুলো কিভাবে তৈরী হবে? অনেকে আবার কিছুক্ষণ এমনি খেলতে দেন এবং পরে ডিভাইস দেন। আমরা এবং আমাদের বাচ্চারা কি এই সময় টুকু ডিভাইস ছাড়া থাকতে পারি না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কারো সাথে কথা বলতেন তখন তার দিকে ঘুরে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন। অথচ আমাদের চোখ থাকে মোবাইলের দিকে। এভাবেতো ঐ ব্যক্তিকে অসম্মান করা হয়। যে সব বাবা মায়েরা এ সময়গুলোতে বাচ্চাদের সামজিক বন্ধন তৈরী করার জন্য ডিভাইস দেন না তাদের এবং তাদের বাচ্চদের মনের অবস্থা তখন কি রকম হয় আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি? অন্যের কথা বাদই দিলাম নিজেই যে নিজের বাচ্চার জীবনটা ধ্বংস করে দিচ্ছি সেটাকি একবারও ভেবে দেখেছি? এ সব বাচ্চারা খুবই অস্থির প্রকৃতির হয়, অমনোযোগী থাকে এবং আচরণগত সমস্যা ভোগে । এছাড়া এরা যত বড় হতে থাকে তত একাকী ডিভাইস নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। কারো সাথে মৌখিক যোগাযোগ করতে চায় না। আসলে মৌখিক যোগাযোগের অভ্যাসটি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। পাশে বসে থেকেও ডিভাইস দিয়ে কথা বলে। তাহলে আমরা কি ভেবে দেখেছি কিভাবে একটা বাচ্চাকে আমরা পঙ্গু করে দিচ্ছি? এ বাচ্চাটি বড় হলে কিভাবে সংসারের, সমাজের দায়িত্ব পালন করবে? কোথাও গেলে বাবা মায়েরা যেহেতু খেয়াল রাখেন না তখন অন্য বাচ্চাদের বাবা মা এবং স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এ ধরণের বাচ্চাদের সামলাতে কি পরিমান কষ্ট করতে হয় সেটা কি একবারও ভেবে দেখেছি? কোথাও গেলে নিজেরা এতোই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি যে, বাচ্চা কি করছে, বয়স অনুপাতে কি ধরণের খেলা খেলছে, কার সাথে মিশছে, কাউকে কষ্ট দিচ্ছে কিনা, কারো ঘরের জিনিস নষ্ট করছে কিনা – এগুলো দেখার সময় নাই। এই যে আমরা এবং আমাদের বাচ্চারা অন্যের মনের কষ্টের কারণ হচ্ছি এবং অসুবিধার সৃষ্টি করছি এতে কি আমরা জুলুমকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবো না? যদি সেটা নাও হই অন্যের অসুবিধা করা, মনে কষ্ট দেয়া এবং এ বাচ্চাটির ভবিষ্যৎ নষ্ট করার জন্য আল্লাহর কাছে আমাদেরকে কি জবাব দিতে হবে না? 

বাচ্চার প্রতি বড় হলেও খেয়াল রাখতে হবে। কখনই বাচ্চারা আমাদের শাসন এবং উপদেশ থেকে বের হয়ে যেতে পারবে না। এমনকি তারা বিয়ে করবে সংসার করবে তখনও কিন্তু আমরা তাদেরকে উপদেশ দিতে থাকবো তাদের নিজেদের ব্যাপারে, ছেলে মেয়ের ব্যাপারে কি করা উচিৎ অথবা উচিৎ না। এ দ্বায়িত্বটা সব সময়ের জন্য। তবে যখন তারা বড় হবে তখন তাদের ভিতরে যে পরিবর্তন আসবে সে সময়টা আমাদেরকে নানা ভাবে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে যাতে এর মধ্য দিয়ে একজন ভালো মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। এক দ্বীনি বোনের জীবন থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। তার ছেলের বয়স যখন ১৩ বছর, সে বিকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে মাথা গুঁজে বসে থাকতো। বাসা থেকে বের হতে চাইতো না কারণ তারা বাবা অফিসের কাজে দেশের বাইরে থাকার কারণে তাকে সব জায়গায় বের হতে দিতেন না। তখন তিনি চিন্তা করলেন কি করলে ছেলের মন ভালো থাকবে। উনাদের ঘরে তখন এটা টেবিল টেনিস ছিলো। তখন উনি ছেলেকে বললেন তার বন্ধুদের বাসায় ডেকে এনে টেবিল টেনিস খেলতে। এরপর থেকে ওরা নিয়মিত খেলতে আসতো এবং ঐ বোন তাদের জন্য নানা ধরণের খাবার তৈরী করতেন। তারা খেলা শেষ করে মজা করে খেতো। এ ভাবে খেলা এবং খাওয়ার মাধ্যমে তারা সুন্দর ভাবে তাদের সময় কাটিয়েছে। এভাবে আমাদের নিজেকে চিন্তা করে বের করতে হবে কিভাবে তারা আনন্দ পেতে পারে এবং মূল্যবান সময়টা কাটাতে পারে। কিভাবে সঠিক উপায়ে তাদেরকে বড় করতে পারবো এবং জীবনের যে পরীক্ষা গুলো, সমস্যা গুলোর মুখোমুখি হবে কিভাবে সেগুলো থেকে তাদেরকে কিভাবে বের করে আনবো সেটা আমাদেরকে চিন্তা করে বের করতে হবে। এভাবেই তাদেরকে একটি সুন্দর শৈশব, কৈশোর উপহার দিতে পারি। ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা আমরা দিতেই থাকবো। এক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের নিজেদের আচরণটা ঠিক করতে হবে তাহলে আমাদের বাচ্চারাও ঠিক হবে ইন শা আল্লাহ্। 

নায়লা নুযহাত