সন্তান প্রতিপালন -১৫

সন্তান আমাদের কাছে আল্লাহর দেয়া আমানত। তাই আমরা এ সন্তানদের নিজেদের সম্পদ ভেবে যেমন খুশি তেমন আচরণ করতে পারিনা। বিভিন্ন সহীহ্ হাদীস থেকে জানতে পারি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সন্তান এবং অন্য বাচ্চাদের প্রতি মমতাও যত্নের সাথে ব্যবহার করতেন। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ দিতেন, হাসি পরিহাস করতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, উটের পিঠে চড়াতেন। তিনি তাদের অনুভূতির ব্যাপারে সহমর্মিতা দেখাতেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি অনুসরণ করে সন্তানের সাথে অত্যন্ত একটা শক্তিশালী বন্ধন তৈরী করতে হবে। যেটার সূত্র ধরে দু’জন আলাপ আলোচনা করতে পারবো। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। পাশাপাশি বয়স অনুপাতে আলোচনা করে নিয়ম শৃঙ্খলার একটা সীমা রেখাও ঠিক করে দিতে হবে যে, কোনটা করা যাবে এবং কোনটা করা যাবে না। এর মধ্যেই সে বড় হবে। তাদেরকে বুক উজার করে ভালোবাসাবো, তাদের আবেগ অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করবো তবে সীমা রেখার মধ্যে। যে সব বাচ্চারা মনের কথা খুলে বলতে পারে, আবেগ অনুভূতি, নিজের মতামত গুলো উচ্চ স্বরে, চিৎকার করে প্রকাশের পরিবর্তে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করতে পারে পরবর্তীতে তাদের আত্মমর্যাদা অনেক বেশী থাকে।

আল্লাহ্ সুরা লুকমানের ১৯ নং আয়াতে বলেছেন,

‘আর তুমি তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর [১] এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করো [২]; নিশ্চয় সুরের মধ্যে গর্দভের সুরই সবচেয়ে অপ্রীতিকর [৩]।’

 ছোট বেলা থেকে কোনটা করতে পারবে আর কোনটা পারবেনা এরকম ‘না’ শুনে বড় হওয়ার কারণে নিজের আবেগ, অনুভূতি গুলো সুন্দর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, ৮০% এর বেশী ‘না’ শব্দটা সরাসরি না বলে বিকল্প সে কি করতে পারবে সেটা বলবো। এ রকম পরিবেশে একটা বাচ্চার সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে তোলা সম্ভব। এখানে সর্বোচ্চ মত প্রকাশের সুযোগ পায় এবং বাবা মা যখন কোন সিদ্ধান্ত বাচ্চাদের সাথে আলাপ করে নেয় তখন দু’পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে সংসারের আমীর যে বাবা এবং তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিবেন এটা বাচ্চাদের মাথায় থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বাবা অবশ্যই জুলুম করবেন না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“তোমাদের সন্তানদেরকে নামাযের আদেশ দাও যখন তাদের বয়স সাত বছর হবে। আর দশ বছর বয়স হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার কর এবং তাদের পরস্পরের বিছানা আলাদা করে দাও।” [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫]

উপরের হাদীসের আলোকে আলেমরা বলেন যে, শুধু মাত্র ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রহার প্রযোজ্য এবং এর গাইড লাইনও আছে। অথচ আমরা বেশীর ভাগ বাবা মায়েরা মনে করি না মারলে বাচ্চা মানুষ হয় না। আমি যেটা বলেছি সেটাই করতে হবে। বাচ্চার মতামত, আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছার কোন মূল্য আমরা দেই না। বাচ্চাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন, খারাপ ভাষায় কথা বলা, ছোট করে কথা বলা সবই করি। এসব বাচ্চাদের আত্মমর্যাদা কম থাকে এবং হীনমন্যতায় ভোগে। পরবর্তীতে এরা যখন বাইরে বড় পরিসরে যায় তখন তারা অন্যের সাথে অতিরিক্ত রাগ দেখায়, খারাপ ব্যবহার করে, চিৎকার চেচামেচি করে, উচ্চ স্বরে এবং খারাপ ভাষায় কথা বলে। ছোট সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুযোগ দেয়া হয় না বলে পরবর্তীতে নিজের জীবনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গুলো ঠিক মত নিতে পারে না এবং আত্মবিশ্বাস কম থাকে৷ নিজের মতামত, আবেগ অনুভূতি, ইচ্ছে ইত্যাদি প্রকাশ করতে না পারার কারণে বুকের ভিতরে একটা ক্ষোভ তৈরী হয়। তখন এই ক্ষোভটা জমে জমে আগ্নেয়গিরির মতো হতে থাকে। এই মানুষ গুলো যখন পরবর্তীতে বাহিরে বের হয় তখন তার চেয়ে যে দূর্বল আছে তার সাথে, অফিসের সহকর্মীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এরা যখন নিজেদের বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে তখন সবচেয়ে ভুক্তভোগী হয় তার স্বামী/স্ত্রী এবং সন্তানেরা। আবার কখনও দেখা যায় বাবা মা মারতে আসলে পাল্টা তারাও হাত তোলে অথবা খারাপ ভাষা ব্যবহার করে।

আমরা ইদানিং এতোই ব্যস্ত থাকি যে বাচ্চার জন্য সময় হয় না। তাই এটা পূরণ করি বাচ্চাকে ঘুষ দিয়ে। এক রকম সন্তানের দাস হয়ে যাই বলা যায়। যখন যা চায় তাই দিয়ে দেই। কোন নিয়ম কানুনের সীমা রেখা নাই। এরা ‘না’ কথাটা শুনে না। কোন অন্যায় আচরণে বাধা পায় না। কোন কিছু চাওয়ার আগেই সব পেয়ে যায়। এরা পরবর্তীতে এমন হয়ে যায় যে, অন্যের কথা বুঝতে চায় না। নিজেরা যেটা বুঝবে সেটাই করবে। এদের ভিতর একটি খারাপ ইগো তৈরী হয়। অন্যের মতামত, আবেগ, অনুভূতির কোন মূল্য এদের কাছে নেই। এরা শুধু নিজেকে ভালোবাসে। এরা ব্যক্তি জীবনে, কর্মজীবনে, পারিবারিক জীবনে এমন অবস্থায় যায় যে, এমন মানুষের সাথে কর্মক্ষেত্র, বাসায় ২৪ ঘন্টা থাকা অসহনীয় হয়ে যায়। এদের মধ্যে পরবর্তীতে যে কোন ধরণের আসক্তি ও ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। ছোট কাল থেকে খারাপ কাজ করতে বাঁধা পায় না বলে সব কিছু থেকেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়।
এরা ‘না’ শুনে বড় হয়নি বলে নিজের মধ্যে আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে না।

তাই আমরা কিভাবে বড় হয়েছি অথবা অন্যরা কি বলে এটা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভুল ভাবে বড় হওয়ার কারণে আমাদের আচার-আচরণে এর খারাপ প্রভাব রয়ে গিয়েছে।অনেক চেষ্টা করেও সবসময় সঠিক আচরণটা প্রয়োগ করতে না পেরে অথবা বিভিন্ন কারণে আমাদের মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে বাচ্চাদের সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলি। পরে আবার নিজেরাই অপরাধ বোধে ভুগি। আমরা মানুষ, আমাদের ভুল হতেই পারে। তাই এমনটা হয়ে গেলে প্রথমে আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবো। তারপর বাচ্চাদের কাছ ক্ষমা চাইবো এবং যে কারণে আমি নিজেকে সংযত করতে পারিনি সেটাও বুঝিয়ে বলবো। এভাবে বাচ্চাদের সাথে সম্পর্কটা সুন্দর করতে পারবো ইন শা আল্লাহ্।

আসুন আমরা গতকাল পর্যন্ত যেমন ছিলাম সেটা ভুলে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পদ্ধতিতে নিজদেরকে এবং সন্তানদেরকে গড়ে তুলি। সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি।

নায়লা নুযহাত