সন্তান প্রতিপালন–১৩

এ যুগের বাবা মায়েরা বাচ্চার পড়ালেখা নিয়ে এতোই চিন্তিত যে তাদের খেলতে (খেলা বলতে এখানে ডিভাইসে গেম খেলা বোঝানো হয়নি) দিতেও চায় না। তারা মনে করেন বেশী খেলতে দিলে একাডেমিক পড়ালেখায় পিছিয়ে যাবে। এছাড়াও মায়েরা সময় দিতে না পেরে অথবা মন অন্য দিকে চলে যাবে ভেবে গৃহ শিক্ষক, কোচিং ইত্যাদির মাঝে ব্যস্ত রাখে। শুধু লেখাপড়া করাতে করাতে একটা বাচ্চাকে আমরা মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দেই। বাবা মায়েরা আমরা নিজেরা বড় বড় ডিগ্রী, নিজেদের ক্যারিয়ার এবং অর্থ উর্পাজনে এতই ব্যস্ত যে, বাচ্চা লালন-পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের সময়ই পাই না। কেউ কেউ আবার এটাকে বুয়াদের কাজ হিসেবে দেখি। সলাত, সিয়ামের মতো এটাও যে একটা ফরজ ইবাদত এটা আমরা চিন্তা করেও দেখি না। শুধু একাডেমিক পড়ালেখার ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

খেলাধুলার মাধ্যমে বাচ্চারা অনেক কিছু শিখে। এটা শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খেলার মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। প্রথম ৫ বছর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এ সময় মস্তিষ্কে হাজার হাজার নিউরোনাল সংযোগ ঘটে। নিউরন হচ্ছে মস্তিষ্কের একক। একটি ঘরের দেয়াল তৈরীতে যেমন ইট লাগে। তেমনি মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য এই নিউরনগুলো ইট হিসেবে কাজ করে। চোখ দিয়ে দেখা, নাক দিয়ে গন্ধ নেয়া ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিউরনের মধ্যে হাজার হাজার সংযোগ ঘটে। এভাবে মস্তিষ্কের আকার বড় হয়।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শিশু বয়স থেকে খেলা এবং উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশুদের সামাজিক বিকাশ, অনুভূতির বিকাশ এবং ভাষাগত বিকাশ ইত্যাদি অনেক বেশী উন্নত হয়। এছাড়াও অভিভাবকরা নিয়মিত তাদের সাথে খেলায় অংশগ্রহণ করলে সেই সব শিশুদের বুদ্ধিমত্তার স্তর অনেক বেড়ে যায়। শুধু খেলার মাধ্যমে একটি বাচ্চার বুদ্ধি বৃত্তি বিকাশ, ভাষাগত বিকাশ এবং সামাজিক বিকাশ প্রতিটি অংশকেই ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়।

খেলা শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। যত তাদের কে খেলতে দেয়া হয় তত তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, দুটি দলের বাচ্চাদের মধ্যে একটি দলকে শুধু একটা লেখা থেকে কপি করতে দেয়া হয়েছিলো এবং আরেকটি দলকে কাদা দিয়ে খেলতে দেয়া হয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পরে দুই দলকে একটি কাজ করতে দিয়ে দেখা গিয়েছে দ্বিতীয় দলের শিশুরা সৃজনশীলতার দিক থেকে এগিয়েছিলো।

একটা বাচ্চাকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে শুধু একাডেমিক পড়া থেকে শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করাটা সঠিক নয়। সৃজনশীল হওয়ার জন্য নিজের মন মতো খেলা, লাফিয়ে ঝাপিয়ে খেলা, রং করা ইত্যাদি খুবই উপকারী। পাশাপাশি কাউকে অনুকরণ করে খেলা যেমনঃ বাবা মায়ের মত সাজা, শিক্ষক সাজা ইত্যাদি এর মাধ্যমে তার সামাজিক যোগাযোগ, অনুভূতি, সৃজনশীলতা, ভাষা ইত্যাদি বিকশিত হয়।

বাচ্চারা যখন বড় হতে থাকে তখন ওরা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যেমনঃ হঠাৎ রেগে গিয়ে কাউকে মারা, বড়দের কথার মাঝখানে বাধা দেয়া, অন্যের কাছ থেকে খেলনাটা কেড়ে নেয়া ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শিশুকে যখন কোন খেলায় সম্পৃক্ত করানো হয় তখন তারা আবেগের উপর ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখে। এ খেলা গুলো যদি ছোট কাল থেকে নিয়মিত খেলতে দেয়া হয় তাহলে তারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে, কঠিন কাজ বেশীক্ষণ করতে পারে। বাচ্চারা যখন খেলে তখন মনের ভিতরের চাপ, কষ্ট ইত্যাদি উপশম হয়। কারণ এতে করে মন ভালো রাখার হরমোন গুলো নিঃসরিত হয়। এই ভালো লাগার প্রভাব পরবর্তী কাজের জন্য উৎসাহ দেয় এবং শক্তি যোগায়। অপর দিকে যদি তাদেরকে ডিভাইসে গেম খেলতে দেয়া হয় তবে এতো বেশী মন ভালো রাখার হরমোন ডোপামিন নিঃসৃত হয় যে, খেলা বন্ধ করে দিলে তারা আর কোন কিছুতে মন বসাতে পারেনা। সব কিছু তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয় এবং আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

সংবেদনশীল খেলা যেমনঃ মাটি, বালি, পানি, গাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে খেলার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে। খেলার মাধ্যমে হারতে শিখে, অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে পারার এবং নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা তৈরী হয়।

আমরা যদি শিশুর জন্য খেলা গুলো নিশ্চিত করতে না পারি তবে যেটা হারাবো সেটা সারাজীবনেও পূরণ হবে না। আপনি হয়তো দেখবেন শুধু একাডেমিক পড়াশোনার দিকে সময় দেয়ার কারনে আপনার বাচ্চা ক্লাসের প্রথম সারিতে থাকছে। কিন্তু বাকী দক্ষতা গুলো অর্জন না করার জন্য সারা জীবন সে অনেক সমস্যার মধ্যে পরবে এবং তার কাছের মানুষগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নায়লা নুযহাত