সন্তান প্রতিপালন–৯

সন্তান জন্মের পরে যে কাজ গুলো করতে হবে –

⏩

 *সুন্দর নাম রাখা :*

নামের মধ্যেও মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। আর মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও ব্যাপক প্রভাব পরে। ভাল নামের বদৌলতে সন্তানের অনাগত দিনগুলো হতে পারে সুন্দর ও মঙ্গলময়। তাই বাবা মায়ের কর্তব্য হলো সন্তানের সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা।

অর্থহীন ও সুন্দর নয় এমন নাম রাখলে এর প্রভাব শুধু তার উপরেই নয়, বরং পরবর্তী বংশধরদের উপরেও পরে। ইবনুল মুসাইয়িব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তাঁর পিতা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর নিকট আসলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? তিনি বললেন, ‘হাজন’ (শক্ত)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নাম পরিবর্তন করে সাহল (সহজ) রাখতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পিতা আমার যে নাম রেখেছেন তা পরিবর্তন করবো না। মুসাইয়্যিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এর পর থেকে আমাদের পরিবারে সদা কঠিন অবস্থা ও পেরেশানি লেগে থাকতো।”  (বুখারী হা/৬১৯০, ৬১৯৩; মিশকাত হা/৪৭৮১)

আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকৃষ্ট নামসমূহ পরিবর্তন করে (ভালো নাম রেখে) দিতেন।” (তিরমিযীঃ ২৮৩৯)

বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের নাম রাখার জন্য সুন্দর বা সঠিক অর্থবহ নাম, আল্লাহ্‌র নামের দাসত্ব বোধক নাম, নবীগণের নাম ইত্যাদি পছন্দ করতেন। ‘আব্দুল্লাহ্’ এবং ‘আব্দুর রাহমান’ নাম দুটি আল্লাহ্‌র নিকট প্রিয়তম বলে তিনি বলেছেন। আর যে সব নামের অর্থ ব্যক্তির নেককারত্ব দাবী করে, বা ব্যক্তির তাকওয়া বুঝায়, যে সকল নামের অর্থ খারাপ বা কঠিন এরূপ নাম রাখতে তিনি অপছন্দ করতেন।

আমাদের বাংলাদেশী সমাজে একটি অত্যন্ত আপত্তিকর অভ্যাস হলো নাম বিকৃত করা। দুইভাবে আমরা তা করি। প্রথমত, নামকে বিকৃত করা। যেমন হাসান-কে হাসান্যা, বা হাসু বলা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্‌র দাসত্ব বোধক নামগুলিকে আল্লাহ্‌র নামে ডাকা। আব্দুর রহমান, আব্দুর রায্যাক, ইত্যাদি অগণিত নাম আমরা ‘আব্দুল’ ফেলে শুধুমাত্র রহমান, রায্যাক, ইত্যাদি নামে ডেকে থাকি। এ বিকৃতি বেশী মারাত্মক, কঠিন গোনাহ্ এবং অনেক ক্ষেত্রে ঈমানের পরিপন্থী। আব্দুল্লাহ্ বা আল্লাহ্‌র দাসকে ‘আল্লাহ্’ ডাকার বা ‘রহমানের দাসকে’ ‘রহমান’ বলে ডাকার চেয়ে ঘোরতর অন্যায় আর কি হতে পারে। আমাদের অবশ্যই এই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।

⏩

 *আক্বীকা করা :*
ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আক্বীকা করা। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহ্‌র নামে যবেহ করা।

সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সকল নবজাতক তার আক্বীকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে।” [সুনান আবু দাউদ: ২৮৩৮]

নবজাতক ছেলে সন্তানের পক্ষ হতে একটি করে বকরী আক্বীকা করা যাবে।

সাহাবী ইরনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পক্ষ থেকে একটি করে বকরী আক্বীকা করেন।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস- ২১/২৮৪১)

আক্বীকার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় পরিবারের সদস্যগণ সহ ধনী দরিদ্র সকলেই খেতে পারেন। হাদীসে ৭ম দিনে আক্বীকা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী যুগে অনেক ফকীহ্ ৭ দিনের পরেও আক্বীকা দেওয়া যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নফল এবং এতে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে সুন্নাতের হুবহু অনুকরণ অনুসরণ উত্তম।

⏩

 *খাৎনা করানো:*

সন্তানের প্রতি মুসলিম পিতামাতার অন্যতম দায়িত্ব তাকে যথাসময়ে খাৎনা করানো। হাদীসে জন্মের সপ্তম দিনেই খাৎনা করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও জন্মের ৭ম দিনের মধ্যে খাৎনা করানো উত্তম। তবে পরে খাৎনা করানো নিষিদ্ধ নয়। খাৎনা উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি করার কোনো নির্দেশ বা অনুমতি হাদীসে দেখা যায় না।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু  ও হুসাইন  রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য তাদের আক্বীকা করেন এবং সপ্তম দিনে খাৎনা করান। (বাইহাকী শুআবুল ঈমান- ৬/৩৯৪)

⏩

 *মায়ের স্তনে সন্তানের অধিকার :*

শিশুর জন্মের সাথে সাথে আল্লাহর রহমতে মাতৃস্তনে সৃষ্টি হয় শিশুর উপযোগী খাবার। সুতরাং পৃথিবীতে কোন মা যেন বিশেষ কারণ ছাড়া স্বীয় দুধপান থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করে শিশুর অধিকার অস্বীকার না করেন। সন্তানকে দুধপান করানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, “যে সকল জননী সন্তানদের পুরো সময় পর্যন্ত দুগ্ধ দান করতে ইচ্ছা রাখে, তারা নিজেদের শিশুদেরকে পুরো দু’বছর ধরে দুগ্ধ পান করাবে” (সুরা বাক্বারাহ আয়াত নং-২৩৩)।

মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানযুক্ত আল্লাহ প্রদত্ত এমন তৈরী খাবার, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে এবং তা শিশুর শরীরের বৃদ্ধি ঘটানোতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুর শরীরের খাদ্য চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে, মায়ের বুকের দুধে অনুরূপ পরিবর্তন প্রতিদিনই ঘটে থাকে। শিশুর দেহ যে পরিমাণ তাপমাত্রা হলে দুধ তার দেহে কাজে লাগতে পারে, সেরূপ তাপমাত্রা মায়ের বুকের দুধে বিদ্যমান থাকে। শিশুকে সুস্থ-সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। মায়ের বুকের দুধে বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকে। মায়ের দুধ পান শিশুর চেহারার লাবণ্য সৃষ্টি করে, বাকশক্তি ও সাধারণ বুদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে।

বিশেষ কারণ ছাড়া কোন মা শিশুকে দুধ পান হতে বঞ্চিত করে যে ক্ষতি সাধন করে, তা অপূরণীয়। কারণ স্তন্যদান মায়ের মধ্যে সৃষ্টি করে শিশুর প্রতি এক বিশেষ স্নেহ প্রবণতা ও আবেগ-অনুভূতি। যে সকল মহিলা তাদের চাকচিক্য ও রূপ-লাবণ্য নষ্ট হবার ভয়ে শিশুকে বুকের দুধ পান করানো হতে বিরত থাকে, তাদের এ হীন মানসিকতা এক্ষুনি পরিত্যাগ করা উচিৎ।

⏩

 *উপহার :*
শিশু জন্মের পর আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সবাই উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে একটি জিনিস লক্ষ্য রাখতে হবে যে কোন ধরনের হারাম উপহার শুধু শিশুই না কাউকেই   যেন আমরা না দেই যেমনঃ মিউজিক যুক্ত খেলনা, পুতুল, প্রানীর ছবি যুক্ত জামা কাপড়, অশ্লালীন জামা কাপড় ইত্যাদি। আমরা অনেকেই দ্বীন পালনের ব্যাপারে সিরিয়াস না। কিন্তু অন্যজনকে যখন দিবো তখন হালালটাই দিবো। যারা দ্বীন পালন করার চেষ্টা করছে তাদেরকে হারাম উপহার দিয়ে সমস্যায় ফেলবো না।

নায়লা নুযহাত