সন্তান প্রতিপালন -১৮

আমরা কিভাবে আমাদের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করি বাচ্চারা খেয়াল করে। আমরা বাচ্চাদের শেখাই কিন্তু নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। নিজেকে রোল মডেল হতে হবে। আমরা অনেক সময় বাচ্চাদের অতিরিক্ত শাসন করে ফেলি কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমরা বুঝতে পারি যে কাজটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। রাগের মাথায় মুখ দিয়ে এমন একটা কথা বলে ফেলি বা করে ফেলি যেটা আমি স্বাভাবিক অবস্থায় বলি না বা করি না। আমি নিজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেখান থেকে সড়ে যাবো অথবা বাচ্চাকে সড়িয়ে দিবো।

কোরআনে আল্লাহ্ বলেছেন, “যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আর আল্লাহ্ মুহ্‌সিনদেরকে ভালবাসেন” (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১৩৪)

রাগের বশবর্তী হয়ে কারো ক্ষতি করে ফেলা বীরত্ব নয়; বরং বীরত্ব হলো, কঠিন রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে ব্যক্তি কুস্তি লড়ে অন্যকে ধরাশায়ী করে, বরং প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিই শক্তিশালী, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮০৯)

আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-কে বলল, ‘আমাকে উপদেশ দিন।’ তিনি বললেন, ‘রাগ করো না।’ সে ব্যক্তি কয়েকবার এ কথা বলল, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘রাগ করো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১১৬)

এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় উম্মতদের রাগ করতে নিষেধ করেছেন।

 *রাগ নিয়ন্ত্রণের কিছু পদ্ধতি। যেমন-*

✅

 দুই ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বসে পরস্পর গালাগাল করছিল। তাদের একজনের চোখ লাল হয়ে উঠল ও গলার শিরা ফুলে গেল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি, যদি সে তা পড়ে তবে তার এ অবস্থা কেটে যাবে। সে বাক্যটি হলো, আমি আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৮১২)

✅

 প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা না করে চুপ হয়ে যাওয়া। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা শিক্ষা দাও এবং সহজ করো। কঠিন করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৪৭৮৬)

✅

 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারো রাগ হয় তখন সে যদি দাঁড়ানো থাকে, তবে যেন বসে পড়ে। যদি তাতে রাগ চলে যায় ভালো। আর যদি না যায়, তবে শুয়ে পড়বে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৪)

✅

 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। নিশ্চয়ই পানির দ্বারা আগুন নির্বাপিত হয়। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন রাগান্বিত হয় সে যেন ওজু করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৬)

✅

 পানি শূন্যতার কারণেও রাগ হয় অথবা মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। তাই বেশী করে পানি পান করতে হবে।

✅

এ সময় কোরআন তিলাওয়াত করলে মন শান্ত হয়।

গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে, বেশী আবেগের সময় ব্রেইনের primitive part চালু হয়ে যায়। তখন কোন Logic কাজ করে না। এর ফলে আমরা এমন সব আচরণ করি যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় করি না। তাই এই সময় চুপ থাকতে হবে। রাগান্বিত ব্যক্তির সাথে আমি তর্ক করবো না, কোন উপদেশ/পরামর্শ দিবো না, সমস্যার সমাধান বলবো না, ভুল করলে ভুল ধরিয়ে দিবো না। সে ভুল করলেও তার রাগ আরো বেড়ে যায়। তাই যখন সে শান্ত হবে তখনই বলবো।

কষ্ট পাওয়া, রাগ হওয়া, ভয় পাওয়া, লজ্জা পাওয়া এসব অনুভূতি গুলো স্বাভাবিক। এমন না যে এগুলো আমাদের হতেই পারবে না। বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকেই এ আবেগ অনুভূতি গুলো নিয়ন্ত্রণ করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একেবারে ছোট বাচ্চারা নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে মাটিতে গড়াগড়ি দেয় চিৎকার চেচামেচি করে। ৪ বছর থেকে কিছু ছোট খাটো জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ১০ বছরের আগে এটা ভালো ভাবে আয়ত্ব করতে পারে না।

 *আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করার সীমা রেখা। যেমন-*

⛔

রাগ হলে চুপ থাকতে হবে, চিৎকার করা যাবে না।

⛔

 তর্ক করা যাবে না

⛔

 খারাপ আচরণ করা যাবে না।

⛔

 ইবাদত বন্ধ করা যাবে না।

⛔

 খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।

⛔

 কথা বলা বন্ধ করা যাবে না। বেশী কথা না বললেও প্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে যেতে হবে।

 *আবেগ/অনুভূতি উত্তম উপায় প্রকাশ করা*

আমরা যদি অনুভূতি প্রকাশ না করে দমিয়ে রাখি তবে সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাগ যখন কমে যাবে মন শান্ত হলে রাগের/কষ্টের কারণটি সুন্দর ভাবে মার্জিত ভাষায় বলবো।

 *সমস্যা সমাধানের চিন্তা ভাবনা করা ।

রাগের কারন চিহ্নিত করে সেটার সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতার কারণে মন আগে থেকেই বিক্ষিপ্ত থাকে যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, জটিল অসুখ, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা, অপুষ্টি, ভিটামিনের স্বল্পতা, পানি শূন্যতা, ঘুমের সমস্যা, বিষন্নতা, উদ্বেগ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিভিন্ন ধরণের আসক্তি (স্ক্রীন, সোস্যাল মিডিয়া, মাদকদ্রব্য ইত্যাদি), পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি। এছাড়া হঠাৎ করে যাতে রাগ না উঠে যায়, মন যাতে প্রশান্ত থাকে সে সম্পর্কে ৮ নং পর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

নায়লা নুযহাত