সন্তান প্রতিপালন -১৭

সম্পর্ক সুন্দর হয় পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে। একে অপরের দুঃখ-কষ্ট বোঝা, সুখে দুঃখে পাশে থাকা ইত্যাদি। অথচ আমাদের সম্পর্ক গুলো এর অভাবে এখন অসুন্দর এবং অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে । বাবা মা সন্তানকে বোঝে না, সন্তান বাবা মাকে বোঝে না। স্বামী/ স্ত্রী একে অপরকে বোঝে না, পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে বোঝে না, বাইরের মানুষও একে অপরকে বোঝে না । অথচ ছোট বেলা থেকে যদি সঠিক ভাবে সন্তানদের তারবিয়াহ্ দেয়া হতো তাহলে আজকে এ অবস্থা হতো না। এই বোঝাপড়াটাই হচ্ছে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence)। এটা বলতে বোঝায়-

*নিজের এবং অন্যের আবেগকে সনাক্ত করতে পারার সামর্থ্য থাকা এবং বুঝতে পারা, 
*নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা 

  • ইতিবাচক ভাবে নিজের আবেগকে পরিচালনা করতে পারা।

একটা বাচ্চাকে অক্ষর জ্ঞান শেখানোর আগে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সি শেখানো জরুরী এটা শুধু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে না আমাদের বড়দের জন্যও জরুরী। 

একটা লম্বা সময়ে মনে করা হতো আই কিউ হচ্ছে মেধার পরিমাপক এবং সফলতার মূল। একটা সময় দেখা গেলো অনেক মানুষের আইকিউ ভালো কিন্তু তাদের জীবনটা ভারসাম্যহীন এবং অসফল। তখন এই পুরো paradigm স্থানান্তর হয়ে গেলো। আই কিউ থেকে সড়ে গিয়েছে ইমোশনাল ইন্টেলেজেন্সিতে। 

যেমন – একজন খুবই ভাল ছাত্র দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে। জীবনের কোন একটা সমস্যার কারনে লেখাপড়া ছেড়ে দিলো অথবা নেশা গ্রস্থ হয়ে গেলো অথবা আত্মহত্যা করলো। এই ছেলেটির অনেক মেধা ছিলো কিন্তু এই মেধা তাকে জীবনে সফল হওয়ার জন্য সাহায্য করলো না। তার আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রনের শিক্ষা, চর্চা না থাকার কারনে সে শুধু মেধা দিয়ে সফল হতে পারলো না। সে শিখেনি কিভাবে জীবনের সমস্যা গুলো সমাধান করতে হয়, প্রিয়জনের বিয়োগকে কিভাবে নিতে হয়, জীবনে কষ্ট এবং যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা গুলো থেকে কিভাবে বের হয় আসতে হয়, নেতিবাচক চিন্তাকে কিভাবে ইতিবাচক করতে হয়। এ দুনিয়াটা পরীক্ষার ক্ষেত্র এবং মুমিনদের জন্য কারাগার। এই পরিপক্বতা যদি আমাদের না থাকে এবং বাচ্চাদের যদি শেখাতে না পারি তাহলে সে কিভাবে এগুলোর মোকাবেলা করবে এবং সফল মানুষ হবে? শুধু মাত্র মেধাতো তাকে সব সময় সফল করবে না।
 
আরেক ভাবে দেখি একজন মেধার কারনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েছে। কিন্তু সে এতোই রাগী এবং মেজাজী একজন মানুষ যে সবাইকে সব সময় ঝাড়ির উপর রাখে। ২০ বছরে হয়তো তার জীবনে অনেক কিছু অর্জন করার কথা কিন্তু সে নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করতে পারছে না, কর্ম ক্ষেত্রে সম্প্রীতি নেই, নিজের আবেগ-অনুভূতির উপর যথেষ্ট পরিপক্কতা নেই। অনেক জায়গায়ই সে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে যেমন ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে ইত্যাদি। সে জানেনা পারিবারিক বন্ধ কিভাবে ধরে রাখতে হয়? স্বামী /স্ত্রী কে কিভাবে সম্মান করতে হয়, সময় দিতে হয়? কিভাবে সহমর্মিতা দিয়ে সম্পর্কের মধ্যে কানেশন বাড়াতে হয়। অন্যের জুতায় দাড়িয়ে সে মানুষটির কষ্ট অনুভব করতে হয়। হতে পারে সে সফল পদবীর ক্ষেত্রে, টাকার ক্ষেত্রে কিন্তু সে সফল ব্যক্তি/সন্তান/বাবা/মা/ স্বামী/স্ত্রী না। কারন সে ইমোশনাল ইন্টেলেজেন্সির দিক দিয়ে পেছানো। আমাদের আবেগ অনুভূতি আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। আমরা কতটা ইমোশনালি ইন্টেলেজেন্ট তার উপর আমাদের সফলতা নির্ভর করে। 
 
বর্তমান সময় বড় বড় কোম্পানিগুলো এবং বহির্বিশ্বে চাকরির ইন্টারভিউতে এখন আর কার রেজাল্ট কত ভালো দেখা হয় না। বরং জানতে চাওয়া হয় –

  • তার লিডারশীপ স্কিল কেমন? 
  • সে কি এই টিমের সাথে কাজ করতে সক্ষম? 
  • তার সামাজিক দক্ষতা কেমন? 
  • তার আরো কি কি দক্ষতা আছে? 
  • সে কত টুকু সৃজনশীল? 
  • কতটুকু ষ্ট্রেস সে নিতে পারে?  
  • সে কতটা সহনশীল? 

এগুলোকে একজায়গায় করে ইমোশনাল ইন্টেলেজেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। একজন অতি রাগী উচ্চ মেধা সম্পন্ন মানুষ যখন একটা টিমে কাজ করে তখন কিন্তু এই টিমের বেষ্ট ইনপুট সে বের করে আনতে পারে না। খুবই ভালো কর্মচারী কিন্তু বসের ঝাড়ির ভয়ে সে বেষ্ট আইডিয়াটা বের করে আনতে পারে না। সে মেধার ক্ষেত্রে অনেক উপরের মানুষ হতে পারে কিন্তু হেরে যাচ্ছে নিজের অতিরিক্ত মেজাজ/রাগের কাছে। পরিবারের ভিতরেও এরা সব সময় অশান্তি করে থাকে। এক কথায় স্বৈরাচারী শাষন ব্যবস্থা চালায়। অথচ আগের পর্বগুলোতে এ সম্পর্কিত হাদিস গুলো থেকে জেনেছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আমাদেরকে পরিবারের সদস্যদের সাথে কোমল আচরণ করতে, সহমর্মিতা এবং সহানুভূতি দেখাতে বলেছেন। 

নায়লা নুযহাত