সন্তান প্রতিপালন -১৬

আগের পর্ব গুলোতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাদের সাথে কেমন আচরণ করতেন সে সম্পর্কে অনেক গুলো হাদীস জেনেছি। সে গুলোর আলোকে বাচ্চাদের সাথে কার্যকরী যোগাযোগের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। লক্ষ্য করতে হবে যে, আমরা যেটা বলছি বাচ্চা সেটা বুঝতে পারছে কিনা। ২/৩ বছরের বাচ্চাদের শব্দের ভান্ডার ঠিকমত তৈরী হয় না। নিজেদের আবেগটাকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। চেহারা দেখে আমাদের অনেক কিছু বোঝার প্রয়োজন হবে।

বাচ্চারা সব সময় বাবা মায়ের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। সেটা ভালো কি খারাপ উপায়ে সেটার পার্থক্য তারা করতে পারে না। যদি তাকে সেটা দেয়া না হয় তখন এমন কিছু একটা করে বসে তখন আমরা মনোযোগ দিতে বাধ্য হই। একটা বাচ্চা হয়তো ২/৫ মিনিটের জন্য আমার কাছে কিছু বলতে চাইলো। এখন আমি যদি এটা না শুনে অথবা খারাপ ব্যবহার দিয়ে ওকে ফেরত পাঠাই তখন তারা মনোযোগ পাওয়ার জন্য এমন সব খারাপ আচরণ করে অথবা এমন কিছু একটা করে বসে যেটার জন্য আমার আধা ঘন্টা থেকে ১ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়।

বাচ্চার সাথে একটা শক্তিশালী বন্ধন গঠনের উপায়ঃ

⏩

 যখন সে আমার কাছে কিছু বলতে আসবে তখন –
*আমরা হাতের কাজ বন্ধ করে তার দিকে মনোযোগ দিবো।
*তার মুখোমুখি বসে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবো।
*তাকে নাম ধরে সম্বোধন করবো।
*সে যেমন উৎসাহ নিয়ে কথাটা বলছে বা দেখাচ্ছে ঠিক তেমনি উৎসাহ নিয়ে সেটা শুনবো অথবা দেখবো।
*তারপর যে বিষয় নিয়ে কথা বলছে সে বিষয়ে আমিও কিছু বলবো যাতে সে বুঝতে পারে যে আমি ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি।
*তারপর কোন পরামর্শ থাকলে সেটা বলবো।

⏩

এছাড়া ওরা যখন নিজেরা খেলতে থাকে অথবা কিছু করতে থাকে তখন ওদের কাছে গিয়ে ৫/১০ সময় ব্যয় করলে ওরা খুবই খুশি হয় এবং উৎসাহ পায়। এতে করে একটু পর পর এসে বিরক্ত করাটা কমে যায়। আবার নিজেও কাজ করার সময় ওকে ডেকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতে পারি।

 এভাবে করলে সাধারণত ১৪/২০ দিন পর এটা বাচ্চার মাথায় গেথে যায় যে তার দিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। এ বন্ধনের মাধ্যমে বাচ্চার আচার-আচরণ সংশোধন করা সহজ হয়।

এভাবে যত বেশী সঠিক উপায়ে তার দিকে মনোযোগ দিবো তত তার খারাপ আচরণ দিয়ে মনোযোগ পাওয়ার পন্থা কমে যাবে। খারাপ আচরণের মাধ্যমে মনোযোগ পেতে থাকলে এগুলোতে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তার চরিত্রের মধ্যে এই খারাপ আচরণ গুলো রয়ে যায়। ভালো কাজে যত বেশী প্রশংসা করবো ততো বেশী আচরণ ভালো হবে এবং ভালো আচরণ করার উৎসাহ বেড়ে যাবে। আর খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে যত বেশী মনোযোগ পাবে ততো এগুলো বাড়তে থাকবে এবং অভ্যাসে পরিণত হবে। এ সময়টায় সঠিক ভাবে সব কিছু করতে পারলে এর ফলপ্রসূ প্রভাব বয়ঃসন্ধিতেও বাচ্চাদের উপর পরবে এবং বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কটাও সুন্দর হবে। সাধারণত এই সময়ে বাবা মায়ের সাথে বাচ্চাদের দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়।

এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে এভাবে কি সম্ভব? আমরাতো এভাবে বড় হয়নি অথবা আমার স্বভাব অন্য রকম। অথবা আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। আসলে মানুষ চাইলেই তার খারাপ অভ্যাস গুলো বদলাতে পারে। যদি না পারতো তবে আল্লাহ্ আমাদের ভালো চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য আদেশ দিতেন না। এছাড়া আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করবো মনোযোগ দেয়ার। যখন পারবোনা তখন সেটা বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলবো।

একটু চিন্তা করে দেখি, আমরা ছেলেবেলায় বাবা মায়ের কাছে যখন কিছু বলতে গিয়েছি তখন উনারা সেটা না শুনে খারাপ ব্যবহার দিয়ে আমাদের সরিয়ে দিতেন। তখন আমাদের কত কষ্ট লাগতো। কড়া গলায় কিছু বললে তখন মনে হতো যে একটু সুন্দর করে বললেই তো আমি শুনতাম বা কাজটি করতাম । অথবা এখনও যদি আমাদের সাথে কেউ আচরণ করে তখন আমাদের কেমন লাগে?
 গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, একটা বাচ্চার যখন মনের কষ্টের কারনে স্ট্রেস বাড়ে তখন কর্টিসল নামক একটি হরমোন রিলিজ হয়। বাচ্চা যদি প্রতিদিন মার খায় তখন তার কর্টিসল বাড়তে থাকে। এটা যদি বেশী হয় তবে মস্তিষ্কের নিউরন গুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে যে সম্ভাবনা পাওয়ার কথা সেটা এসব কারনে নষ্ট হয়ে যেতে পারে যদি না আল্লাহ্ তাকে রক্ষা করে।

এছাড়া শরীরে কর্টিসলের পরিমান বেশী হলে একটা প্রদাহজনিত রোগের তৈরী হয়। এটা থেকে অল্প বয়সে লিভারের সমস্যা, হার্টের সমস্যা, শ্বাস কষ্ট, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং আরো অনেক ধরনের শারীরিক রোগ দেখা দেয়। এছাড়াও কিছু মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা যেমন আত্মহত্যার প্রবনতা, ডিপ্রেশন, এ্যাংজাইটি, রিস্কি সেক্সচুয়াল বিহেভিয়ার করার প্রবনতা, মদ্যপায়ী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। এগুলো বড়দের বেলাও হয়।

আমরা মানুষ, আমাদের ভুল হতেই পারে। সব সময় একই রকম ব্যবহার করতে পারি না। কখনও যদি বাচ্চার সাথে অথবা অন্য কারো সাথে খারাপ আচরণ হয়ে যায় তবে সাথে সাথে ভালো আচরণ করবো। কেন খারাপ আচরণ করেছিলাম সেটা বুঝিয়ে বলবো এবং দুঃখ প্রকাশ করবো। এতে করে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হওয়া বন্ধ হবে। বাচ্চার মধ্যে যে আচরণ দেখতে চাই সেটা নিজের মধ্যে আগে ধারণ করতে হবে। তারা আমাদের দেখে শিখে, শুনে শিখেনা। তাই নিজেরা ওদের কাছে রোল মডেল হবো।

নায়লা নুযহাত